আপনাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনাদের মধ্যে কত জন আছেন যারা নতুন কোনো বাংলা শব্দ শিখতে বা কোনো বাংলা শব্দের অর্থ জানতে কতটা আগ্রহী, আপনাদের উত্তর কি হবে? আমাকে যদি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে হয় শতকরা ৮০% মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক কি দেওয়া যায় তা নিয়ে তারা বেশ বিরম্বনায় পরবেন। অথচ এই একই প্রশ্ন যদি ইংরেজির ক্ষেত্রে করি উত্তর টা তখন বেশ সহজেই দেওয়া যাবে। আমাদের মধ্যে ইংরেজি শেখার যে আগ্রহ বা চেষ্টা দেখা যায় কখনো কি ভেবে দেখেছেন এই একই রকম চেষ্টা আমরা আমাদের মাতৃভাষার ক্ষেত্রে কেন দেখাই না?
বাংলাদেশের এই চিত্র কয়েক দশক আগেও এমন ছিল না। গত কয়েক দশকে দেশে যত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হয়েছে এমনটা যে হবে এইটা যদি আমাদের আরো ৩০ বছর আগে কেউ বলতো তাহলে বিশ্বাস তো দূরের কথা হয়তো হেসেই উরিয়ে দিতাম কথাটা। কিন্তু আজ আমাদের এমন পরিস্থিতি যে ছেলে-মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে না পরানো মানে আপনি যেন বাবা-মা হিসেবে পিছিয়ে গেলেন। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বাংলাদেশে প্রথম আবির্ভূত হয় ততকালীন ব্রিটিশ আমলে, সাল ১৯১২। সেই তখন থেকে শুরু হয়ে কালের পরিবর্তনে আজ বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা ১৩০ ছারিয়েছে। ঠিক কেন আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের এত আধিপত্য ? উত্তর টা খুবই সহজ,কেননা আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের ভাষাকে যতটা না গুরুত্ব দেই তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেই পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের সংস্কৃতিকে। অবশ্যই জাতি হিসেবে এগোতে হলে আমাদের নিজেদের পাশাপাশি অন্য সংস্কৃতি এবং তাদের ভাষা গুলোকে জানতে হবে, জানতে হবে তাদের সম্পর্কে। পৃথিবির সব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল গুলতে বেশিরভাগ পাঠ্যক্রম ইংরেজি তেই হয়ে থাকে। কিন্তু তাই বলে এই না আমরা নিজেদের ভাষাকে অবজ্ঞা করে অন্য সংস্কৃতি এবং তাদের ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দিব। ইংরেজি চর্চার এই বিস্তার হয়েছে মুলতঃ কয়েকটি কারনে, পশ্চিমা গান, সিনেমা এবং তাদের নাটকের তুমুল জনপ্রিয়তা,পোশাক এবং ফ্যাশন জগতে তাদের আধিপত্য, এমন কি তারা কৃষি, অবকাঠামো,প্রকৌশল সব কিছুতেই সেরা। আমাদের মধ্যে এই মনভাব নেই যে আমরা তাদের পথ অনুসরণ করে আমাদের দেশ, রাষ্ট্র, এবং ভাষাকে এগিয়ে নেই, তা না করে আমরা তাদের সংস্কৃতিকে আমাদের সাথে মিলেয়ে জগাখীচুরি করে ফেলছি।

আমাদের এশিয়া মহাদেশের দেশ গুলোকে যদি লক্ষ্য করা যায় যেমন করিয়া, চায়না, জাপান তারা কখনই নিজেদের সংস্কৃতির বাহিরে অন্য সংস্কৃতি বা তাদের ভাষাকে প্রাধান্য দেন না এবং তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে উপস্থাপন করার যোগ্য করে তুলেছেন । শুধু সংস্কৃতি না, তারা নিজের দেশের বিভিন্ন দিক গুলো উন্নত করে নিজেদের দেশের নতুন পরিচয় স্থাপন করেছেন। আমেরিকা জাপানে ১৯৪৫ সালে হিরোসিমা এবং নাগাসাকি তে যেই নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ করেছিল সেই ঘটনার পর জাপানের আজ এই উন্নয়ন বিশ্বের কাছে এক মাইলফলক। তাদের স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, অফিস বা কোনোস্থানে ইংরেজিতে কোনোলিখুনি নেই অথচ অন্য দিকে আমরা ইংরেজি বলতে পারাকে একধরনের প্রতিভা হিসেবে গণ্য করি।

এমনটা আমাদের আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে প্রায় দেখা মিলবে। বন্ধুদের আড্ডায় যেই বন্ধু গুলো কথায় কথায় ইংরেজি বলবে বা অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ করবে তাদেরকেই “cool” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। এমন অনেক দেখা যায় যে আমরা বিদেশি নাগরিকদের সাথে কথা বলার সময় যতটা না সচেতন থাকি তার চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক থাকি আমাদের নিজেদের দেশের মানুষের সঙ্গে কথপোকথন করার সময়, আমাদের মস্তিষ্কে এই ব্যাপারটা সবসময় থাকে যে আমরা যদি কোনোভুল বা অশুদ্ধ ইংরেজি বলি লোকের কাছে আমাদের হেয়ো হতে হবে। আমাদের অশুদ্ধ বাংলা বলা নিয়ে কোনোঅসুবিধা না হলেও ভুল বা অশুদ্ধইংরেজি বলা নিয়ে সবসময় ভয়ে থাকতে দেখা যায়। একটি ভুল ইংরেজি শব্দ বা বাক্য আমাদের সম্মান নষ্ট করে কিন্তু আধ-ভাঙ্গা বাংলা আমাদের cool বা smart করে, আমাদের সমাজে এখন এই ব্যাপারটাই যেন স্বাভাবিক। এমন কি বাবা-মায়েরা চান যাতে তাদের বাচ্চারা অশুদ্ধ বাংলা বা “বাংলিশ” ভাষায় কথা বলে। ব্যাপারটা সত্যিই কষ্টের কিন্তু এটাই আজকের বাস্তবতা, অবশ্যই এই ব্যাপারটা সবার ক্ষেত্রে সমান না তবে আমাদের আশে-পাশে খুঁজে দেখলে এমন অনেক অভিভাবকেরই দেখা মিলবে। অন্য দিকে যারা শুদ্ধবাংলার প্রয়োগ করছে তাদের ব্যঙ্গ করে আঁতেল, আবুল এই জাতীয় নামে ডাকা হচ্ছে। কোনো বড় অনুষ্ঠান, সমাবেশ বা আনুষ্ঠানিকতায় এমন সব লোকদের দারা উপস্থাপনা করানো হচ্ছে যারা কি না বাংলার সঠিক ব্যবহার না করে ইংরেজির উপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন,এতেও আমাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পরছে। আমরা পরক্ষ ভাবে এইটা চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি যে অশুদ্ধ বাংলার ব্যবহার না করলে হয়তো আমরা সমাজ ব্যবস্থার বাইরে চলে যাচ্ছি।

আমরা কেন বা ঠিক কি কারনে ইংরেজি ভাষাকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছি, জাতি হিসেবে আমরা ইংরেজিকে প্রাধাণ্য দিয়ে কত দূর এগুতে পেরেছি ওইটা নিয়ে আমরা চিন্তা করছিনা। কে কত ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারছি সেইটাই যেন আমাদের কাছে বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আমরা যতদিন না বাংলা ভাষাকে নিজস্ব পরিচয় পরিচিত করব, যতই ইংরেজিতে পারদর্শী হইনা কেন নিজেদের জাতি হিসেবে কখনোই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব না। আগে আমাদের সত্যিকার অর্থে একজন ভালো বাঙ্গালী হয়ে উঠতে হবে শুধু মাত্র তখনি পারব আমরা বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে বাচঁতে।