আমার লিখার শিরোনামটি উৎসর্গ রাখবার কারণ টি শেষে বলছি। প্রথমেই একটা প্রশ্নে চলে যাই। আপনাকে যদি এখন প্রশ্ন করা হয় শেষ কবে ক্যাসেটের ফিতায় গান শুনেছেন? অথবা শেষ কবে কনসার্টে গিয়েছেন,অথবা শেষ কবে বিকেলে চায়ের সাথে প্রিয় ব্যান্ড বা শিল্পীর গান শুনতে শুনতে হারিয়ে গেছেন?
উত্তরগুলো পাবার জন্য যদি তাকিয়ে থাকি এবং যদি আপনি ৮০ কিংবা ৯০ দশকে জন্ম নেয়া কেউ হন তাহলে আমি আপনার চোখে সেই হারিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাস কিংবা সেই রুপালী শৈশব বা কৈশোর দেখতে পাবো তাতে কোন সন্দেহ নেই। যখন ছিল ক্যাসেটের সেই যুগ। প্রিয় ব্যান্ড বা শিল্পীর কনসার্টে উদ্দামতা এবং বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বাংলা ব্যান্ডের গানের লাইনগুলো গুনগুন করে গাওয়া অথবা বিকেলে বারান্দায় টেপ রেকোর্ডারে বসে শোনা সেই গানগুলো। আমিও বাদ যাব কেন? আমিও তো সেই ৯০ দশকের ই মানুষ।আপনার সাথে হারাতে আমার নেই মানা। তবে চলুন না একটু ঘুরে আসি আমাদের সেই স্বর্নযুগে….
বাংলা ব্যান্ডের কথা কেন বলছি বারবার? কারণ, আমাদের সেই নব্বই দশকের সময়টায় সবচেয়ে বেশি যে গানগুলো চলতো সেটা বাংলা ব্যান্ডের গান। যুগটা ছিল সবকিছুর বাঁধা পেরিয়ে,কিছুটা নিয়মরীতি পিছনে ফেলে শিকল ভাঙার যুগ। দেশটার বয়সও তখন তরুণ। তাই ই হয়ত উদ্দামতা ছিল অনেক বেশি।
বাংলাদেশের ব্যান্ড বা বাংলাদেশী ব্যান্ড বলতে বাংলাদেশে প্রচলিত রক ঘরনার সঙ্গীত ব্যান্ড বোঝায়। উনিশ শতকের ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ব্যান্ডের সূচনা ঘটে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে ৭০ ও ৮০’র দশকে বাংলাদেশে রক ঘরনার ব্যান্ডের বিস্তৃতি ঘটে।
বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের নাম শুরু করলে সবার আগেই আসে একজন প্রবাদ পুরুষের নাম। মহান মুক্তিযোদ্ধা ” মাহবুবুল হক আজম” যাকে আমরা পপ সম্রাট ” আজম খান” নামে চিনি। স্বাধীনতা পরবর্তি বাংলাদেশী ব্যান্ড মিউজিক সিন শুরুই হয়েছিলো তার গঠিত ব্যান্ড ” উচ্চারণ” এর হাত ধরে। “ওরে সালেকা,ওরে মালেকা”, “আলাল-দুলাল” কিংবা “পাপড়ি” এই গানগুলা যারা শোনেন নি তারা হয়ত আসলেই অনেক কিছু মিস করেছেন। তবে তাঁর “রেললাইনের ওই বস্তিতে/জন্মেছিল একটি ছেলে/মা তার কাঁদে/ছেলেটি মরে গেছে/হায়রে হায় বাংলাদেশ” গানটি কে না শুনেছেন,তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়।

এরপর বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকে যোগ হলো নতুন জনরা পপ রক। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে শুরু করেছিলো “ মাইলস , সোলস , ফিডব্যাক,ফিলিংস ( নগর বাউল*), রেনেসা “ । এই পাঁচ টা ব্যান্ড এর কথা বলতেই হবে । শুধু পরিবর্তন নয়, বাংলা মিউজিক সিনারিও তে সেই সময় এনেছিলো যুগান্তকারি পরিবর্তন। তাদের গান গুলোর স্পেশালিটি ছিলো নিজেদের ব্যাসিক কম্পোজিশন ধরে রেখে সুর এবং ভোকালের উপর বেশী জোড় দেয়া। রাস্তার মোরে মোরে প্রথম ব্যান্ড মিউজিক পৌছে দিয়েছিলো কিন্তু এই ব্যান্ডগুলো ই। এর পর আসলো ওয়েভস নামে একদল তরুন , ভুবন ভুলানো হেভি মেটাল যা শুনে বাঙালি তাদেরগান কে অপসংস্কৃতি বলে আখ্যায়িত করলো। এই তরুন ব্যান্ড যা কিছু করেছিলো জার্মানিতে বসেই। সেসময়ের সংগীত প্রেমীরা সেইভাবে নেয় এই ধারার সংগীত কে। ফলে এই প্রতিভাবান ব্যান্ড টি হারিয়ে গেলো জেগে ঊঠার আগেই।

কেউ চলে যায় কাউকে যায়গা দিতেই। চলে আসলো বাংলা ব্যান্ড মিউজিক সিনারিও কে বদলে দেওয়া চারটা ব্যান্ড । বাংলাদেশের চার স্বপ্নের ব্যান্ড ” রকস্ট্রাটা, ইনঢাকা , এসেস, ওয়ারফেজ” । হার্ড রক/ হেভী মেটাল দিয়ে পুরো জাতিকে নতুন ভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিলো সর্বপ্রথম কিন্তু এই ব্যান্ড গুলোই। এদের মাঝে ছিলো মিউজিকাল একচেঞ্জ। এরা নামে চারটা ব্যান্ড হলেও সবাই ই ছিলো একে অপরের অনেক কাছাকাছি। ছিলো বিশাল একটা শক্তি। ওয়েভসের দেখানো পথ ধরে বাংলাতেও যে হেভী মেটাল করা যায় তা সেইটা শক্ত ভাবে প্রতিষ্টা করে গেছে ব্যান্ড গুলো। এর পর আসলো “ ডিফরেন টাচ, উইনিং ,নোভা , এল আর বি, আর্ক, পেন্টাগন, পেপার রাইম, লিজেন্ড, সুইট ভেনম, অবসকিউর ” এর মত ব্যান্ড যাদের সব কিছুই ইতিহাস কে এগিয়ে নিয়ে গেছিলো অনেক অনেক দূরে। এই ব্যান্ড গুলো নিজেরাই একেকটা ইতিহাস যা আমরা সবাই জানি।

আইয়রন মেইডেন এর গান শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই চার জন বন্ধু প্ল্যান করলো ব্যান্ড করবে এবং তারা গড়ে ফেললো আজকের ” ক্রিপটিক ফেইট” । এদিকে বাপ্পা মজুমদার এবং সঞ্জীবদা মিলে অন্য ধরনের ব্যান্ড “দলছুট” সৃষ্টি করলো । ফিডব্যাক ছেড়ে মাকসুদ উল হক তৈরি করলেন তার ব্যান্ড ” মাকসুদ ও ঢাকা “ । এর পর আসলো বুয়েটের আঙ্গিনায় বেড়ে উঠা একদল প্রবাদ পুরুষ, যাদের গান শুনে রেকর্ড লেভেল প্রথমে ফিরিয়েই দিয়েছিলো ,। তারা আর কেউ নাই আজকের ব্যান্ড ” শিরোনামহীন” । গড়ে উঠলো “ভাইকিংস, দ্যা ট্র্যাপ” এর মত ব্যান্ড ।

ওয়ারফেজ বেজিস্ট বেজবাবা সুমন ওয়ারফেজ ছেড়ে তৈরী করলেন এ যুগের অন্যতম সফল ব্যান্ড ‘অর্থহীন ‘ । সেদিন যদি বেজবাবা এভাবে না ভাবতেন , ওয়ারফেজ এর সাথে যদি এখনো থেকে যেতেন , তাহলে কি আমরা পেতাম ‘অর্থহীন ‘ ???

এই ছিলো বাংলার সোনালী নব্বই । গর্বের নব্বই। নব্বই যেমন দিয়েছে আমাদের কে অসাধরন সব গান তেমনি দিয়েছিলো কিছু ব্যান্ড যারা শাসন করেছে ২০০০ পরবর্তী সময়।
১৯৯৯ । বাংলা ব্যান্ড পেলো একসাথে কিছু অমর রত্নের সন্ধান। আর সেই ব্যান্ড গুলোর গান কে এক করে ইশা খান দূরে রিলিজ করলেন মিক্সড এলব্যাম ” ছাড়পত্র“। এই ছাড়পত্র এবং পরের বছর রিলিজ পাওয়া ” অনুশীলন” এলব্যাম কে অনেক সংগীত বোদ্ধারা যুগান্তকারী এলব্যাম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
সেই ছাড়পত্র এলব্যাম দিয়ে আগমন ঘটালো অনেক আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড যার মধ্যে “আর্টসেল , ব্ল্যাক , মেটাল মেজ, coprophilia , এবং নেমেসিস” অন্যতম। আর্টসেল, ব্ল্যাক, নেমেসিসের পরের খবর তো সবার ই জানা।

এর পর স্টেনটোরিয়ান, আর্বোভাইরাস , ক্রাল , দ্যা ওয়াটসন ব্রাদার্স , রিবর্ন , এর মত ব্যান্ড গুলোও এগিয়ে যেতে লাগলো । শহরতলী নামে সম্পূর্ণ অন্যধারার গান শুরু করলো একদল অন্য জগতের মানুষ । এর পর আসলো আরো একটি মেজর টার্ন । “ দ্যা রক স্টার ” এই শো এর মাধ্যমে ” পাওয়ারসার্জ , রেডিও এক্টিভের, মেকনিক্স , দৃক ” এর মত ব্যান্ড চলে আসলো ইন্ডাস্ট্রিতে।

ভাইব । আফসোস এর যদি কোন সমার্থক শব্দ থাকে তাহলে সেটাকে একবারে বলা যাবে ভাইব। এক এলব্যাম দিয়েই স্বর্ণ শিখরে পৌছে গিয়েছিলো ভাইব। কিন্তু তারপর থেকেই হারিয়ে গেলো।
মিনেরভা, শুন্য, চিরকুট, পরাহো, বে অফ বেংগাল, অশ্রুত, এক্লিপ্স, রিকল, ক্রিমিটিক্স এক্স, ডি ইলুমিন্যাশন, গ্রুভ ট্রাপ , ক্রিমেটিক এক্স, স্কেয়ার ক্রো , পয়জন গ্রীন, ই এফ, ওয়ারসাইট, লালন, মেঘদল , মহাকাল , সহজিয়া , এভোয়েড রাফা, ইন্ডালো, নাগরিক, নোনতা বিস্কুট,ওল্ড স্কুল , পেন্টাগন , দ্যা ট্রী এর মত ব্যান্ড নিজ নিজ অবস্থানে থেকে আজ মাতাচ্ছে পুরো বাংলাদেশ ।

আমাদের আছে কিছু ট্যালেন্টেড আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড। ” Orator, Burial Dust, Satanic, Nafarman, Grimorium Verum, Enmachined, Abominable Carnivore, Thrash, Zerg, Naive , Homicide” তাদের মধ্যে অন্যতম। যাদের হাতে বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার রুপরেখা বর্তমানে বসেই অংকন করা যায় ।
সময়টা এখন ২০২০। সেই নব্বই দশক থেকে আজ পর্যন্ত পেরিয়ে গেছে অনেকটুকু সময়। অনেক ব্যান্ড ই এখন তাদের রজত জয়ন্তী,৩০/৪০ বছর পার করে ফেলেছে। অনেক ব্যান্ডের অনেক ধরনের ভাঙা-গড়া কিংবা পরিবর্তন সাধন করেছে।কোন ব্যান্ড হয়ত মাঝে মাঝে নতুন গান বের করছে অথবা কেউ তাদের পুরোনো গানগুলোতেই স্টেজ মাতিয়ে রাখছেন এখনো। আবার এরই মাঝে আমরা হারিয়ে ফেলেছি ব্যাণ্ডের অনেক কিংবদন্তীদের কে। সবাই কে এক করে দিয়ে গুরু আজম খান চলে গেছেন সেই ২০১১ সালে। “আর বেশি কাঁদালে,উড়াল দেবো আকাশে” গাইতে গাইতে চলে গেলেন শুধু বাংলাদেশ ই না উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ গিটারিস্ট আইয়ুব বাচ্চু। অনেকেই আছেন, সবার কথা মনে পড়ছে না। হাত কাঁপছে এবং চোখও ভিজে যাচ্ছে।
কি? হারিয়ে গিয়েছিলেন তো কিছু সময়ের জন্য? হারানোর ই কথা। সেই যুগ হয়তবা আর ফিরে পাবো না। কিন্ত তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক এই যুগে আর্কাইভের মাধ্যমে তাদের অবশ্যই ধরে রাখা সম্ভব। ইউটিউব এখন একটি বড় মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে আর্কাইভের। তবে সবকিছুই কেন যেন অগোছালো। আরেকটু সুন্দরভাবে, যত্নসহকারে বাংলা ব্যান্ডের এই গানগুলো কি সুন্দর/সুগঠিত ভাবে আর্কাইভ করা যায়না? যেই গানগুলো একসময় ক্যাসেটের বাজার মাতিয়েছে,সেই গানগুলো বাণিজ্যিকভাবে ইউটিউবে নতুনভাবে রিলিজ দিলে আমার মনে হয় তখনকার চেয়ে কম সাড়া ফেলবে না আমার মতে।
আমার লিখার শিরোনাম টি উৎসর্গ রাখবার কারণটি এখন বলছি। যাদের গান শুনে শৈশব,কৈশোর এবং যৌবনের একটা সময় কেটেছে কিংবা এখনো কাটছে তাদের কে এই লিখাটা উৎসর্গ করলাম। বাংলা ব্যান্ডগুলোর কাছে আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞ এবং চিরঋণী। ভাল থাকুক বাংলা ব্যান্ড,ভাল থাকুক বাংলা ব্যান্ড এবং ভাল থাকুক সোনার বাংলাদেশ।