পূর্বে এমন একটা সময় ছিল যখন দম্পতিরা তাদের সন্তান, মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই মিলে একসাথে যৌথ পরিবার হিসেবে থাকত। বর্তমানে যৌথ পরিবার প্রায় নেই বললেই চলে। যৌথ পরিবারের পরিবর্তে এখন দেখা যায় একক পরিবার যার সদস্য সংখ্যা মাত্র ৩ থেকে ৪ জন। তবে বর্তমানে সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের সংখ্যাও কম নয়।
সকল দম্পতিই বিয়ের আগে সারাজীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি নিয়েই তারা তাদের নতুন জীবনের পথে যাত্রা শুরু করেন। চলার পথে স্বভাবতই তাদের সম্মুখীন হতে হয় অনেক বাধা- বিপত্তির। এর মাঝে যারা একে অপরের উপর বিশ্বাস করে পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে সক্ষম হয় তারাই কেবলমাত্র সারাজীবন একসাথে থাকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সক্ষম হয়।
সময়ের সাথে সাথে তারা প্রবেশ করে জীবনের আর একটি নতুন ধাপে তাদের জীবনে আসে তাদের সন্তান। পরম মমতায় বাবা-মা একত্রে বড় করে তোলে তাদের সন্তানকে। তবে বর্তমানে এখন অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা একসাথে তাদের সন্তানদের বড় করতে সক্ষম হয়না। দাম্পত্য কলহের কারনে কিংবা জীবন সঙ্গী মারা গেলে ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে যায় একটি পরিবার । উন্নত বিশ্বে সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের সংখ্যা অনেক হলেও উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে এ সংখ্যা কম। এক গবেষণায় দেখা গেছে সারা বিশ্বে বাবা-মা তাদের সন্তান- সন্ততি নিয়ে বাস করে এমন পরিবারের সংখ্যা ৩৮ শতাংশ সেখানে USA তে এই সংখ্যা মাত্র ১১ শতাংশ (তথ্যসুত্রঃ পিউ রিসার্চ সেন্টার)
সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের নানাবিধ বাধার সম্মুখীন হতে হয়ঃ
১। সন্তানদের অভিভাবকত্বঃ দম্পতিদের মধ্যে বিচ্ছেদের পর কিংবা জীবন সঙ্গী মারা যাবার পর প্রথম প্রশ্ন আসে সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে। বেশিরভাগ দেশের আইনেই সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তাঁর মায়ের কাছে থাকতে পারে, এ সময় তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয় বাবাকে। এর পর পর সন্তান যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয় তখন তারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা কার কাছে থাকতে চায়।
২। মানুষিক বিপর্যয়ঃ বিচ্ছেদের পর কিংবা জীবন সঙ্গীর মারা যাবার পর যেকোনো মানুষই মানুষিক ভাবে বিপর্যস্থ হয়ে পরে, বিচ্ছেদের কষ্টে হারিয়ে ফেলে নিজেকে। জীবনের প্রতি সব আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। এর মধ্যে রয়েছে একাকি সন্তানকে বড় করে তোলার দায়িত্ব। সব মিলিয়ে জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসে।
৩। একাকীত্বঃ সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের জীবনের অন্যতম একটি বাধা হল তাদের জীবনের একাকীত্ব। দাম্পত্য বিচ্ছেদ কিংবা জীবন সঙ্গীর মারা যাবার পর তাদের জীবনকে গ্রাস করে নেয় একাকীত্ব। বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানোর মত কোন সঙ্গী যখন থাকেনা, যে মানুষটার সাথে জীবনের দীর্ঘ সময় কাটানো হয়েছে হুট করেই যখন সেই মানুষটার হাত ছুটে যায়, ঘরে ফিরে এসে খালি বাসায় আরও বেশি করে অনুভূত হয় একাকীত্ব যা তাকে করে তোলে আবেগময়। এসময় পরিবারের সবাই মিলে একসাথে কাটানো সুখের দিনের স্মৃতি মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়।
৪। অপরাধবোধঃ সিঙ্গেল প্যারেন্টসরা নানা রকম দ্বিধায় ভোগেন। তাদের মধ্যে কাজ করে একধরনের অপরাধবোধ। তাদের মনে আশে নানা রকমের প্রশ্ন। তারা ভাবতে থাকে হয়ত বিচ্ছেদ তাঁর নিজের দোষেই হয়েছে, তাঁর আরও বেশি ধৈর্য ধারণ করা উচিত ছিল। সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের মনে যে প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি অপরাধবোধ তৈরি করে তা হল- তাদের সন্তান বড় হয়ে তাঁর মা-বাবার নেওয়া বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তকে কিভাবে দেখবে? এছাড়াও তারা ভাবে তাদের পরিবার বা বন্ধুরা তাদের এই বিচ্ছেদেকে কিভাবে দেখবে? এসময় তারা নানারকম দ্বিধা দন্দে জর্জরিত থাকে।
৫। আর্থিক সমস্যাঃ বাবা কিংবা মা সন্তান যার কাছেই থাকুক না কেন অভিভাবকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে বাধাটি আসে তাহল আর্থিক সমস্যা। একজন বাবা কিংবা মা একা তাঁর সন্তানের ভরন পোষণের দায়িত্ব নিতে সক্ষম হবে কিনা এসমস্ত বিষয় বিবেচনা করেই সন্তানের কাস্টডি অভিভাবক কে দেওয়া হয়। কারন একা একজন বাবা কিংবা মার পক্ষে সন্তানের সব চাহিদা পুরুন করে তাকে বড় করে তোলা অনেক কঠিন। এ জন্য তাদের আর্থিক ভাবে সামর্থ্য হতে হয়।
৬। সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়াঃ উন্নত বিশ্বে সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের সংখ্যা অনেক হলেও উন্নয়নশীল দেশ গুলোতে এ সংখ্যা কম। সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের জীবনের অন্যতম একটি বাধা হল সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়া। সমাজের মানুষ বিভিন্ন ধরনের অবান্তর মন্তব্যের মাধ্যমে সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তাদের মনে এমন ধারনা ঢুকিয়ে দেয় যে কারনে সিঙ্গেল প্যারেন্টসরা ভাবতে বাধ্য হয় যে তারা বোধহয় একা তাদের সন্তানদের বড় করে তোলার জন্য যথেষ্ট নন।
সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের তাদের সন্তানদের বড় করতে হয় একা। একা সন্তানদের দায়িত্ব নিয়ে তাদের বড় করে তোলা মোটেও সহজসাধ্য কোন বিষয় নয়। অনেক সময় পরিবারের মানুষজনদেরও সাহায্য পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে একজন সিঙ্গেল প্যারেন্টসকে পালন করতে হয় একসাথে মা এবং বাবা ২জনেরই দায়িত্ব।
সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের দায়িত্বঃ
১। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াঃ যেকন মানুষের জন্যই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া দরকার। একজন সিঙ্গেল প্যারেন্টস এর জন্য তাঁর সন্তানের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করে তাকে সুখে রাখার জন্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ কেননা, তাকে একাই তাঁর সন্তানের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করতে হবে। যদিও সন্তান যদি মা এর কাছে থাকে সেক্ষেত্রে সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের খরচ বাবাকেই বহন করতে হয়। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে সন্তানের অভিভাবকত্ব পাওয়া সহজ হয় মা কিংবা বাবার জন্য।
২। সন্তানদের বড় করে তোলার জন্য সুখী এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করাঃ সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল সন্তানদের জন্য সুখী এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। কারন তারা কেবল মাত্র মা কিংবা বাবা একজনের সান্নিধ্যে বড় হয়ে উঠে, একারনে অনেক সময় সন্তানদের উপর বিরুপ প্রভাব পরে। যদি সিঙ্গেল প্যারেন্টসরা তাদের সন্তানের জন্য সুখী এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে সন্তানদের মানুষিক অবস্থা ভেঙ্গে পরে, কেননা তারা তাদের সামনেই তাদের সহপাঠীদের বাবা-মা উভয়ের সান্নিধ্যে-ভালবাসায় বড় হয়ে উঠতে দেখছে। একারনে অনেক সময় তাদের মনে মা কিংবা বাবার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অনুভুতি জন্মায়, যার কারনে তাঁর মানুষিক স্থিতি নষ্ট হয়।
৩। সন্তানদের যথাযথ ভাবে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করাঃ বর্তমানে প্রতিটি মা বাবাই সচেতন তারা তাদের সন্তানদের নিয়মিত স্কুল এ পাঠায়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় সিঙ্গেল প্যারেন্টসরা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে শুধু মাত্র স্কুল কিংবা প্রাইভেট টিউটর এর উপর নির্ভর করতে হয়, কারন তারা সন্তানদের সময় দিতে পারেনা। এ কারনে তাদের সন্তানরা লেখাপড়ায় পিছিয়ে থাকে। এজন্য সিঙ্গেল প্যারেন্টসরা যদি তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য আলাদা ভাবে মনোযোগ দেয় তাহলে তাদের সন্তানও পারবে ভাল ফলাফল করতে।
৪। সন্তানকে মূল্যবোধ শেখানোঃ সন্তানকে মূল্যবোধ শিখানো প্রতিটি বাবা মারই কর্তব্য। ভাল খারাপ বিবেচনা বোধ ছোট বেলা থেকেই শিখাতে হয়। আর সিঙ্গেল প্যারেন্টসরা যেহেতু মা-বাবা ২ জনের ভুমিকাই পালন করে তাই তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। অনেক সময় দেখা যায় সিঙ্গেল প্যারেন্টসরা তাদের সন্তানদের যথাযথ মূল্যবোধ শিক্ষা দিতে পারেনা, যার কারনে সন্তানরা মা কিংবা বাবা যার সহচর্য থেকে বঞ্চিত হয় তাকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করে। আর তাই প্রতিটি সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের উচিত তাদের সন্তানদের ছোট বেলা থেকেই সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা দিয়ে যথার্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
৫। সন্তানদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়াঃ অনেক সময়ই দেখা যায় সিঙ্গেল প্যারেন্টসরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের উপর বেশি কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করে তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়না, যার কারনে সন্তানের উপর বিরূপ প্রভাব পরে।
৬। সন্তানের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়াঃ যেহেতু সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের জীবন অনেকটাই তাদের সন্তানকে কেন্দ্র করেই, আর তাই অনেক সময় দেখা যায় তারা তাদের সন্তানের প্রতি বেশি প্রোটেক্টটিভ হয়ে সন্তানের সিদ্ধান্ত কে মেনে নিতে চায় না। সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের উচিত সন্তানের সিদ্ধান্ত কে গুরুত্ব দেয়া।
৭। সন্তানকে সময় দেওয়াঃ প্রতিটি সন্তানই তাদের মা-বাবকে অনুকরন করে। এক্ষেত্রে সন্তান যেহেতু মা কিংবা বাবা শুধু মাত্র একজনের সহচর্যে বড় হয় সেহেতু সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের উচিত তাদের সন্তানকে বেশি সময় দেওয়া। যেহেতু সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের কাজ করতে হয় সেহেতু অনেকসময় তারা তাদের সন্তানদের সময় দিতে পারেনা যার কারনে সন্তানের উপর বিরূপ প্রভাব পরে। তাদের উচিত সন্তানকে সময় দেওয়া এবং ছোট বেলা থেকেই যাতে তাদের মধ্যে ভাল গুনের সমাবেশ ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখা। এছাড়াও ছোট বেলা থেকেই সন্তানের সাথে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা যাতে সন্তান তাঁর মা কিংবা বাবার সাথে সব কথা শেয়ার করতে পারে।
সিঙ্গেল প্যারেন্টসদের নানা রকম বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে গিয়ে তাদের সন্তানদের বড় করে তুলতে হয়। এসময় তারা যদি শুধু মাত্র তাদের বিচ্ছেদের শোকে অস্থির না হয়ে তাদের সন্তানের কথা ভেবে তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর প্রতি মনোযোগ দিয়ে কিভাবে তার সন্তানদের ভালোভাবে বড় করে তোলা যায় সে কথা চিন্তা করে তবে তাদের পক্ষে মানুষিক কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে জীবন কে নতুন করে শুরু করা সম্ভব হবে।