পুরাতন মিউজিক ডিরেক্টররা মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, কি যুগ আসলো, সব গানে অটোটিউন। আমাদের সময় কি ভাল ছিল, কি সুন্দর অটোটিউন ছাড়া গান করতাম। শিল্পীরাও ছিল বাঘা বাঘা ইত্যাদি ইত্যাদি।
বর্তমান যুগে মিউজিক বা সংগীত যেটাই বলেন না কেন এটা নিয়ে কাজ করতে গেলে সংগীতকারেরা যেন অটোটিউন ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারেন না। পশ্চিমা বিশ্বের সংগীতকারদের থেকে শুরু করে আমাদের উপমহাদেশীয় শিল্পিরা সবাই যেন এখন এই অটোটিউন জ্বরে আক্রান্ত।
অটোটিউন প্রথম ব্যবহার হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। পশ্চিম বিশ্বের গায়ক শের(cher) তার বিলিভ(believe) গানে এই অটোটিউনের ব্যবহার করেছিলেন।

অটোটিউনের উদ্ভাবক ডক্টর অ্যান্ডি হিল্ডব্র্যান্ডকে প্রশ্ন করা হয় কেন মিউজিশিয়ানরা অটো টিউনকে সংগীত নষ্ট করার জন্য দায়ী করেন, তার উত্তরে তিনি বলেন অটোটিউন শুধুই অনুশীলনের জন্য তৈরি হয়েছিল এবং কারো জানার কোন প্রয়োজন ছিল না যে গানে কোন সফটওয়্যার ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে এটির ব্যবহার যে এরকম আকাশচুম্বী হয়ে যাবে সেটা হয়ত হিল্ডব্র্যান্ড নিজেও কল্পনা করেননি।

পরবর্তীতে গত একযুগে ধীরে ধীরে অটোটিউন নতুন জেনারেশনের কানে সুন্দরভাবে জায়গা করে নেয়। তাছাড়া এটা যুগ, টেস্ট ও টেকনোলোজির চাহিদা। কাউকে দোষ দিয়ে কোন লাভ নেই। মুভির ডিরেক্টর যদি চায় অটোটিউন, তাহলে মিউজিক প্রোডিউসারের কিছুই করার নেই। এখন মোটামুটি ৬৫% গানে ব্যবহ্রত হচ্ছে অটোটিউন। শুধু আমাদের স্টুডিওতে নয়, বম্বেতেও। এখন স্টুডিওতে গেলে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার জিজ্ঞেস করেন, অটোটিউন দেব? অতিনিকটে এমন একটা সময় আসছে যখন এলাকার বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অমুক তমুকদের গানেও সেখানকার বকলম সাউন্ড ইঞ্জিনিয়াররা অটোটিউন ব্যবহার করবে।
এই অটোটিউন এর কারণে গান গাওয়াটা অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে। সেটার ব্যবহার আমাদের সিনেমা মাধ্যমেই দেখা যায়। পাশ্চাত্য সিনেমাগুলোতে গানটা অত আবশ্যিক না হলেও আমাদের উপমহাদেশে গান সিনেমার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই আমাদের সিনেমার সুচনালগ্ন থেকে গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রবাদক, গায়ক-গায়িকা এবং সঙ্গীত পরিচালকেরা চেষ্টা করেছেন এর উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করার। ফলে আমাদের সিনেমা থেকে আমরা পেয়েছি অনেক কালজয়ী শ্রুতিমধুর গান। মুখ ও মুখোশ সিনেমাকে যদি আমাদের প্রথম সবাক কাহিনীচিত্র ধরে নেই তবে বাংলাদেশী সিনেমার প্রথম সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার ছিলেন সমর দাস। প্রথম গীতিকার আব্দুল গফুর সারথী, গায়ক আব্দুল আলীম, গায়িকা মাহবুবা রহমান।

পরবর্তীতে আমরা পেয়েছি আব্দুল লতিফ, আলতাফ মাহমুদ, খান আতাউর রহমান, সুবল দাস, দেবু ভট্টাচার্য্য, সত্যসাহা, কলিম শরাফী, আজাদ রহমান, কমল দাসগুপ্ত, রবিন ঘোষ, আলাউদ্দিন আলী, শেখ সাদী খান, আনোয়ার পারভেজ সহ আরো অনেক গুণী সংগীত পরিচালককে। সুরেলা কন্ঠের যাদুতে মুগ্ধ করেছেন ফেরদৌসী রহমান, নীনা হামিদ, মীনা বশীর, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, বশীর আহমেদ, আব্দুল জব্বার, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, শাহনাজ রহমতউল্লাহ, খন্দকার ফারুক আহমেদ, মোহাম্দ আলী সিদ্দিকী, খুরশীদ আলম, শাম্মী আক্তার, মিতালী মুখার্জি, সুবীর নন্দী, রফিকুল আলম, রথীন্দ্রনাথ রায়, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, আবিদা সুলতানা, এন্ড্রু কিশোর সহ অনেক সংগীত গুণী শিল্পী। তাদের নিরলস সাধনায় আমরা পেয়েছি অসংখ্য হৃদয়ছোঁয়া গান।কিন্তু অনেকেরই মনে আফসোস কাজ করে যে এই অটোটিউনের যুগে আমরা কেন আগের মত সেরকম কালজয়ী গান পাচ্ছি না? চলুন দেখে আসি গান তৈরির সেকাল কেমন ছিলঃ

পরিচালক তার কাহিনীর প্রয়োজনে গানের জন্য যেতেন সঙ্গীত পরিচালক বা কম্পোজার এর কাছে। গীতিকার কথা লেখা শেষ করলে সুরকার সুর তৈরী করে স্কোর (Score) লিখতেন। তারপর চলত গায়ক-গায়িকা ও অর্কেষ্ট্রা (Orchestra) বাদকদের রিহার্সাল। এই রিহার্সাল অনেক সময় ধরে চলত। একবারে পারফেকশন না আসলে সেটা ওকে হত না। সবকিছু মনঃপুত হলে তারপর এনালগ এ্যাকুষ্টিক (Acoustic) পদ্ধতিতে সাইন্ড ইঞ্জিনিয়ার এর সহায়তায় সঙ্গীত পরিচালক একটি গান রেকর্ড করতেন। সকল যন্ত্রী বা অর্কেষ্ট্রা বাদকদের বাজনা বাজানো (Ensemble) ও গায়ক-গায়িকাদের কন্ঠদান একই সময়ে একসাথে হতো বলে গানটি অনেক জীবন্ত মনে হতো। আর এভাবেই সেকালে সৃষ্টি হত এক একটি গান।
আর যদি এখন আমরা দেখি গান তৈরির প্রক্রিয়া সেক্ষেত্রে, বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকজন বাদ দিয়ে অধিকাংশ সিনেমা পরিচালক প্রযোজকের ইচ্ছায় বিজাতীয় গানের সুরে কথা বসানোর দ্বায়িত্ব দেন গীতিকারকে। তারপর কম্পোজার তার বাসায় প্রতিষ্ঠিত রেকডিং ষ্টুডিওতে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে একটা ডেমু (Demo) তৈরী করে দেন। সেটা মনঃপুত হলে গায়ক-গায়িকা ষ্টুডিওতে হাজির হন কন্ঠ দেবার জন্য। তাতে থাকেনা কোন রিহার্সালের বালাই।
লাইভ অর্কেষ্ট্রেশন এর ঐক্যতান এখন কল্পনাতীত বিষয়। কম্পোজার এর সংগ্রহের ভান্ডারে থাকা কোন পিস বা কিউ (Cue) এর স্যাম্পলিং (Sampling) খারাপ হলে তখন এক দুইজন যন্ত্রীকে ডেকে আবার সেই পিস রেকর্ড করা হয়। ক্ষুদ্র পরিসরের ষ্টুডিও তে (যদিও নুন্যতম ২০’x২০’ হওয়া উচিৎ) সাউন্ড রেকর্ড করার কারনে সেই এ্যাকুষ্টিক আবহ টা পাওয়া যায়না। অর্কেষ্ট্রেশন আবশ্যিক হওয়া সত্যেও যখন কপি পেষ্ট করা নিচুমানের পিস ও রিহার্সাল ব্যতিত কন্ঠ দেয়ার কারনে গানের থাকেনা কোন সজীবতা (যদিও বিভিন্ন সফটওয়ার এর সাহায্যে নিয়ে কম্পোজার প্রতিবন্ধকতা দুর করার চেষ্টা করেন)। বাজেট স্বল্পতার কারনে কম্পোজার একাই সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, অর্কেষ্ট্রেটর ও কম্পোজার এর দ্বায়িত্ব পালন করেন। আরো উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে নিত্য নতুন গায়ক-গায়িকা ও কম্পোজার বের হয়েছেন যারা প্রকৃত দক্ষতা অর্জনের আগেই মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দ্রুত খ্যাতির আশায়। এঘরানার অধিকাংশ গায়ক-গায়িকার নেই কোন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দীক্ষা আর কম্পোজার এর নেই নিজ হাতে মিউজিক নোটস (Notes) লেখার সামর্থ্য !! সবজায়গায় শুধু চলছে কপি পেষ্ট করা। তাহলে কিভাবে পাব সেই কালজয়ী গান!!
পরিশেষে এটাই বলতে চাই, এই অটোটিউনের যুগে এসে গান গাওয়াটা হয়ত খুব সোজা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু গান ব্যাপারটার মধ্যে যে মধুরতা বা স্বকীয়তাটা আছে সেটা এই অটোটিউন, ,মিক্সিং বা সহজ কথায় , গান সহজকরণের দৌড়াদৌড়িতে আমরা গানের আকর্ষণটা হারিয়ে ফেলছি নাতো?
Chhandarina Geeti -
Very good writing and very useful for this indeed. Well, keep writing so that we can read.