সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে সংঘটিত অগ্নিসংযোগ বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচাইতে ভয়াবহ দাবানলগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে দাবি করছে স্থানীয় প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা সমূহ। গত ২রা জানুয়ারি, নিউ সাউথ ওয়েলস এক সপ্তাহব্যাপী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে, অস্ট্রেলিয়ায় আগুন লাগার পর এইবার তৃতীয়বারের মতো জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে (এনবিসি নিউজ)।
২০১৯ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া মারাত্মক খরার পর আগুনের সূত্রপাত হয়, যার ধ্বংসলীলা এখনও অব্যাহত রয়েছে। দাবানলের কারনে এ পর্যন্ত অগ্নি নিরাপত্তা কর্মীসহ মোট ২৪ জন মারা গেছে, শুধুমাত্র নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যেই ২ হাজারেরও বেশি বাড়িঘর ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য দেশ ও স্থানীয় আগুন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগুনের কারনে ক্রমাগত তাপ এবং খরা বাড়ার ফলে এখন পর্যন্ত দাবানল অব্যাহত রয়েছে।
গত ৩রা জানুয়ারি, অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া ব্যুরো ভিক্টোরিয়ার পূর্ব গিপসল্যান্ডে তীব্র বজ্রপাতের আশঙ্খা ব্যক্ত করে সতর্কতা জারি করেছে। তীব্র আগুন এবং ধোঁয়ায় অন্য রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলসেও ঝড়ো হাওয়ার পূর্বাভাষ দেখানো হয়েছে।

⦁ অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলের সূত্রপাত
রাষ্ট্রীয় সংস্থা ভিক্টোরিয়া ইমার্জেন্সি অনুসারে, ডিসেম্বরের শেষ দিকে ভিক্টোরিয়ার পূর্ব গিপসল্যান্ড অঞ্চলে শুকনো বজ্রপাতের ফলে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। অতি শুষ্ক আবহাওয়ার কারনে যা মাত্র পাঁচ ঘন্টার মধ্যে ২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গায় ছড়িয়ে পরে।
কিন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন একে মানব সৃষ্ট অগ্নিসংযোগ বলেও দাবি জানাচ্ছে। পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিউ সাউথ ওয়েলসে পুলিশ “ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোজনের” দায়ে কমপক্ষে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করেছে এবং নভেম্বর থেকে ১৮৩ জনের বিরুদ্ধে উক্ত অপরাধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
অস্ট্রেলিয়ায় বনাঞ্চলে দাবানল একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সাধারণত, অস্ট্রেলিয়ায় গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া থাকার ফলে, শুষ্ক পরিবেশ এবং প্রচণ্ড বাতাসের কারনে বনাঞ্চলে প্রায় সময়েই আগুন ধরে। নিউ সাউথ ওয়েলস এর “পরিকল্পনা, শিল্প ও পরিবেশ অধিদপ্তরের” মতে, আবহাওয়া প্রায়শই গরম এবং শুষ্ক থাকার কারনে দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যে অঞ্চল মুলত ভিক্টোরিয়া রাজ্য এবং নিউ সাউথ ওয়েলস এর কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত। এছাড়াও এই অঞ্চলের যে ধরণের উদ্ভিদ জন্মায় তা অত্যন্ত উষ্ণ এবং শুষ্ক প্রকৃতির, যা সহজেই আগুনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
নিউ সাউথ ওয়েলস রুরাল ফায়ার সার্ভিস দাবি করেছে, এখন পর্যন্ত অব্যাহত এই ভয়াবহ দাবানল আবহাওয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে ধাবিত করছে। ভয়াবহ এই দাবানলের ফলে অস্ট্রেলিয়ায় ডিসেম্বরে তাপদাহ দেশব্যাপী সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙেছিল, যা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (প্রায় ১১৩-১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) উপরে তাপমাত্রা উঠে গিয়েছিল।

⦁ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই কি এই দাবানলের সূত্রপাত?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে জলবায়ু পরিব
র্তনের ফলে অস্ট্রেলিয়াতে আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার জলবায়ু পরিষদের এক এন জি ও ২০১৪ সালে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল যে, জলবায়ু পরিবর্তন “অতি উষ্ণ দিন” এর প্রবণতা এবং তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে এবং সাথে সামনের বছর গুলোতে দাবানলের সম্ভাবনাও বাড়াচ্ছে।
এতে আরও বলা হয়েছে যে এই পরিস্থিতি অস্ট্রেলিয়ার অনেক জায়গায় দাবানলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেবে এবং দাবানলের মৌসুমকে দীর্ঘায়িত করবে।
অস্ট্রেলিয়ান আবহাওয়া বিজ্ঞান ব্যুরোর সিনিয়র গবেষণা বিজ্ঞানী মিঃ ক্রিস লুকাস এবং ভিক্টোরিয়া রাজ্যের কান্ট্রি ফায়ার অথোরিটির গবেষণা ও বিকাশের ব্যবস্থাপক এমএস সারা হ্যারিসও সমর্থন করেছিলেন, যে দক্ষিনের জলবায়ু পরিবর্তন অস্ট্রেলিয়ার শুস্ক মৌসুমে দাবানলের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে বলে তারা মনে করেন, যা সামনে আরও বৃদ্ধি পাবে বলেও তারা দাবি করেছিলেন।

⦁ ক্ষয়ক্ষতির পরিমানঃ
আগুনের তাণ্ডব ঝোপঝাড়, কাঠের বাগান এবং “ব্লু মাউন্টেন” মত জাতীয় উদ্যান ধ্বংস করে দিয়েছে। মেলবোর্ন ও সিডনি সহ অস্ট্রেলিয়ার কয়েকটি বৃহত্তম শহরও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, যেখানে আগুনের ফলে বাইরের শহরতলিতে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ঘন ধোঁয়ার কারনে নগর কেন্দ্র থেকে লোকজন সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে সিডনিতে ধোঁয়ার পরিমান এতটাই খারাপ অবস্থায় বেড়ে গিয়েছিল যে এখানকার বায়ুর মান জীবকূলের জন্য “বিপজ্জনক” এর মাত্রায় ১১ মাত্রায় চলে এসেছে।

শুধুমাত্র নিউ সাউথ ওয়েলসেই ১০০ টিরও বেশি জায়গায় আগুন এখনও জ্বলছে। কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের গোল্ড কোস্ট এবং ব্রিসবেনের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিও বিপজ্জনক দাবানলের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার ছয়টি রাজ্য জুড়ে মোট ৭.৩ মিলিয়ন হেক্টর (১৭.৯ মিলিয়ন একর) জায়গা পুড়ে গেছে, যা আকারে বেলজিয়াম এবং ডেনমার্কের মিলিত দেশগুলির চেয়েও বড় জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ রাজ্যটি হল নিউ সাউথ ওয়েলস, দেশের অন্যতম জন বহুল রাজ্য, যেখানে ৪.৯ মিলিয়ন হেক্টর (১২.১ মিলিয়ন একর) বেশি অঞ্চল পুড়েছে, ১৫০০ এরও বেশি বাড়ি পুড়ে গেছে এবং হাজারের বেশি মানুষ এখন ঘর ছাড়া।
নিউ সাউথ ওয়েলসের বনাঞ্চল জুড়ে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন প্রাণী আগুনে ক্ষয় ক্ষতির শিকার। সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুবিদদের মতে, এই সংখ্যা দেশব্যাপী এক বিলিয়নেরও বেশি হতে পারে। প্রায় এক তৃতীয়াংশ কোয়ালা আগুনে মারা গিয়েছে বলে ধারনা করা হচ্ছে এবং তাদের আবাসের এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ফেডারেল পরিবেশমন্ত্রী সুসান লে। এদের মধ্যে এমন প্রাণী যেমন বিলুপ্তপ্রায় ব্যাঙ ও পাখিদের বেশ কয়েক ধরনের প্রাণী পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। কেননা এখন পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রনে আসে নি তাই এখনি মোট ক্ষয় ক্ষতির পরিমান বলা সম্ভব নয়। নিউ সাউথ ওয়েলসে বর্তমানে প্রায় ২০০০ হাজারের বেশি দমকল বাহিনী আগুন নিয়ন্ত্রনে কাজ করছে, এছাড়া কানাডা, ইউ এস ও নিউজিল্যান্ড আগুন নেভাতে এগিয়ে এসেছে। ফেডারেল সরকার সামরিক সহায়তা হিসেবে সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনীর বিমান এবং নৌবাহিনীর ক্রুজার গুলিকে দমকল, উচ্ছেদ ও উদ্ধারকাজ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য প্রেরণ করেছে।
আগুনের পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে বলা এখুনি সম্ভব নয়, কেননা অস্ট্রেলিয়াতে এখন গ্রীস্মকাল যা ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তাই আশংখা করা হচ্ছে এই ক্ষয় ক্ষতির পরিমান সামনে আরও বাড়বে।
সুত্রঃ বিবিসি, সি এন এন, টুডে