চুল মানুষের সৌন্দর্য্যের একটি অংশ। চেহারায় সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলতে চুলের জুড়ি নেই। বিশেষ করে মহিলা দের ক্ষেত্রে চুলের মাধ্যমেই যেন তাদের আসল সৌন্দর্য প্রকাশ পায়।অনেকে মনে করে থাকেন যত ঘন,লম্বা চুল তত বেশি সৌন্দর্য।তবে সব চুলের আলাদা সৌন্দর্য আছে।হোক সেটা লম্বা বা খাটো, ঘন বা পাতলা চুল। চুলের যত্ন নেওয়ার পিছনে অনেকে দিন রাত লেগে থাকে। চুল যেন লম্বা, ঘন, সুন্দর এবং মসৃণ হয়।অনেকে আবার লম্বা চুল থাকা কে ঝামেলা মনে করে।তাই অনেকে লম্বা চুল কেটে ছোট করে ফেলে।অনেকে চুলে নতুন স্টাইল করার জন্য বিভিন্ন বিউটি পার্লারে বা সেলুনে গিয়ে চুল কেটে থাকে। কিন্তু এই চুল কাটার পর সেই কেটে ফেলা চুলের কি করা হয়? কোথাও ফেলে দেয় নাকি অন্য কাজে লাগায়?এমন প্রশ্ন হয়তো আমাদের অনেকের মনেই ঘুরাফেরা করে।হ্যাঁ এর উত্তরও আছে।এই চুল দিয়ে অনেক কিছু করা হয়। এই ফেলে দেয়া চুলগুলো দিয়েই চুল শিল্পগুলো মোটা অঙ্কের অর্থ উপার্জন করছে।
মানুষের মাথার পরিত্যক্ত চুল এখন একরকম বিশেষ ধরনের রপ্তানি যোগ্য পণ্য।একসময় দেখা যেতো মা-বোনরা চিরুনি দিয়ে মাথা আঁচড়াতো। একে অপরের চুল আঁচড়িয়ে দিতো। বিকালবেলা বাড়ির উঠোনে বা ঘরের বারান্দায় চলতো চুল আঁচড়ানোর প্রতিযোগিতা। আঁচড়ানের সময় চিরুনিতে কিছু ছেঁড়া চুল লেগে থাকতো। সেগুলো মুড়িয়ে থুতু দিয়ে ফেলে দিতো। সব মায়েরা ছেঁড়া চুলে থুতু দিয়ে ফেলতো কিনা তা জানা নেই। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মা-বোনরা ছেঁড়া চুল থুতু দিয়ে বেশি ফেলতো। ছেঁড়া চুলে থুতু না দিয়ে ফেললে নাকি, মাথার চুল ঝরে পড়ে যায়। এটা ছিল আগেকার বুড়ো বুড়িদের একটা কুসংস্কার রটানো কথা। আর পুরুষ মানুষের মাথার চুল কেটে সাধারণত ফেলেই দেওয়া হতো। পুরুষের কাটা চুল ফেলার কোনও নিয়মকানুন ছিল না, এখনো নেই। এখন নারীপুরুষের কারোর চুলই ফেলনা নয়। এগুলো এখন খুবই মূল্যবান জিনিস। সময়সময় দেখা যায় শহরের সেলুনের নিচ থেকে পরিত্যক্ত চুল অনেককে কুড়িয়ে নিতে।
কিন্তু আগেকার সময় কেউ ভাবেনি যে, এই ফেলে দেয়া চুল একদিন বিদেশে রপ্তানি হবে। যা দিয়ে আমাদের দেশ আয় করবে বৈদেশিক মুদ্রা।এখন প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে যেসব প্রকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, তার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে ফেলে দেওয়া এই চুল। জানা যায় চুল রপ্তানি করেই প্রতিবছর দেশের আয় হচ্ছে, কোটি কোটি টাকারও বেশি। আবার এরমধ্যে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের জীবন জীবিকা। দূর হচ্ছে বেকারত্বের অভিশাপ, স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেক মানুষ।
প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর পড়েও জানা যায়, এই ফেলে দেওয়া চুল ব্যবসার খবরাখবর। আবার স্বচক্ষে দেখাও যায়, শহরের অলিগলিতে ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহকারী ফেরিওয়ালাদের। তাদের কাছ থেকে জানা যায়, এই পরিত্যক্ত চুল ব্যবসার বিষদ বিবরণ ও এর ভেতরকার রহস্য। পরিত্যক্ত চুলকে ঘিরে দেশে গড়ে উঠেছে কয়েকশ’ শিল্প প্রতিষ্ঠান। তাদের মতো অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে, এই চুল ব্যবসায় জড়িত থেকে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা, বিশেষ করে ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, মাগুরা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাদারীপুর থেকে শহরে আসছে এসব চুল সংগ্রহকারী দল। তারা জানায়, উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, রংপুরসহ অনেক জেলাতেই গড়ে উঠেছে পরিত্যক্ত চুল শিল্প। ওইসব জেলাগুলোতে গড়ে উঠেছে, তিন শতাধিক চুল প্রক্রিয়াকরণ কারখানা। যারা উত্তরাঞ্চল জেলাশহর থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় আসছে, তারা ঘুরে ঘুরে চুল সংগ্রহ করে নিয়ে যায় উত্তরাঞ্চলে। সেখানে তাদের মহাজন আছে। মহাজনরা তাদের হাজার হাজার টাকা দাদন দিয়ে রাখে। যাতে সংগ্রহ করা চুল অন্য মহাজনের কাছে বিক্রি করতে না পারে। তারা ঘুরে ঘুরে পরিত্যক্ত চুল সংগ্রহ করে প্রতিমাসে একবার মহাজনের কাছে যায়। সংগ্রহ করা চুল বুঝিয়ে দিয়ে, তাদের পাওনা বুঝে নিয়ে আবার চলে আসে বিভিন্ন জেলাশহরে।
তারা মহাজনের কাছ থেকে পাইকারি দরে পেয়ে থাকে, গড়ে প্রতি কেজি ১৪-১৫ হাজার টাকা। অনেক মুনাফা অর্জনকারী ব্যবসা এই চুলের ব্যবসা। শহর থেকে সংগ্রহ করে নেওয়া চুল যাচাইবাছাইয়ের পর, এগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়।আর এই চুল গুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের পর চলে যায় চীন, কোরিয়া, মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন বড় বড় দেশে। যেখানে চুল দিয়ে তারা পরচুলা, ক্যাপ, টাক মাথায় হেয়ার প্ল্যান্টেশন সহ আরো অন্যান্য কাজে ব্যবহার করছে। যেগুলো অনেক টাকায় তারা বিক্রি করছে।অথচ বাংলাদেশ থেকে কম দরে তারা এই চুলগুলো ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ এসব চুল রপ্তানি করে যে লাভবান হচ্ছেনা তা বলা যাবেনা।লাভ হচ্ছে। এই চুল রপ্তানির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে চুল সংগ্রহের বড় বাজার। এসব চুল সেলুন ও বিউটি পার্লার থেকে সংগ্রহ করা হয়। লম্বা চুলের চাহিদা বেশি।দাম ও বেশি। লম্বা চুল দিয়ে পরচুলা বানানো হয়। বর্তমানে চীন, জাপান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ায় চুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এগুলো দিয়ে পরচুলা, কৃত্রিম চুল, চোখের ভ্রু তৈরি হয়। বাংলাদেশে এসব পণ্য তৈরির চারটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠান চুলের তৈরি পণ্যও রপ্তানি করছে। এরকম ভাবেই পুরো বিশ্বে চুল দিয়ে অনেক অর্থ উপার্জন করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতও চুল রপ্তানি করে বেশ লাভবান হচ্ছে। হলিউড, যুক্তরাজ্য থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত মানুষ যে নকল পরচুলা ব্যবহার করে তার অধিকাংশই আসে ভারত থেকে। প্রতিবছর ভারত এই চুল বিক্রি করে প্রায় আড়াইশ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করে। এক কিলোগ্রাম ওজনের চুল বিক্রি হয় কমপক্ষে ১৩০ থেকে ১৫০ ডলারে।তাই ভারতে মানুষের চুল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।দক্ষিণ ভারতে দুটি মন্দির আছে নাম “তিরুপাতি বালাজি মন্দির” এবং ” তিরুতান্নি” যেখানে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ্যাধিক মানুষ জড়ো হয়।অধিকাংশ মানুষই তাদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হবার বাসনা নিয়ে হাজির হন ওই মন্দির দুটোতে। বলা হয়, দক্ষিণ ভারতের এই মন্দির দুটোতে দেবতা খুবই জাগ্রত এবং তাদের কাছে শুদ্ধ মনে ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা পূরণ হয়। কিন্তু মনোবাঞ্ছা পূরণে দিতে হয় কোনো কিছুর বিসর্জন বা বলিদান। তীর্থ ভ্রমনকারীদের মধ্যে এই বলিদান করার ক্ষেত্রে নিজেদের মাথার মুন্ডিত করা বা চুল ফেলে দেয়ায় প্রবনতা বেশি দেখা যায়। যুগ যুগ ধরে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরে এই রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে।হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এই চুল ফেলে দেয়া বা কামানো নিয়ে বেশকিছু মিথ আছে। বলা হয়, ভগবান বিষ্ণুর মাথায় একবার কুঠারের আঘাত লাগায় তিনি কিছ চুল হারান। তখন নীলা দেবী নিজে উদ্যোগী হয়ে ভগবান বিষ্ণুকে এক গোছা চুল দান করেন। সেই থেকে যদি কেউ নিজের চুলের বিনিময়ে ভগবান বিষ্ণুর কাছে কিছু চান, বলা হয় সেই চাওয়া পূরণ হয়। একারণেই প্রতিবছর দক্ষিণ ভারতের তিরুতান্নি এবং তিরুপাতি মন্দির দুটো থেকে টনকে টন মানুষের চুল সংগ্রহ করেন চুল সংগ্রাহকরা।ধারনা করা হয়, প্রতিদিন তিরুপাতি মন্দিরে এক লাখেরও বেশি পূণ্যার্থী আসেন এবং বছরে এই পূণ্যার্থীদের মাথার কামানো চুল থেকেই মন্দিরটির আয় আছে প্রায় তিন মিলিয়ন ডলার। এই অর্থ মন্দিরের স্কুল এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়।
অন্যান্য উন্নত দেশও চুল শিল্পের মাধ্যমে বেশ লাভবান হচ্ছে।প্রাইস মেশিন নামের একটি ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, আমেরিকার বাজারে মানভেদে পরচুলার খুচরা মূল্য ১০ ডলার থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত। দেশ ও মানভেদে দামের রকমফের রয়েছে। পরচুলা, ভ্রু ও চোখের পাতার কৃত্রিম লোমের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাজ্য।
এভাবেই চুল বিশ্বের প্রতিটি দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।চুল এখন আর আগের দিনের মত পরিত্যক্ত ফেলনা জিনিস নয়। চুলের মাধ্যমেই এখন বিশ্বের বিশাল বিশাল চুল শিল্পগুলো চলছে।
Kawsar Ahmedhimel -
Wow 😍😍
Very nice post.
Many thanks to Trisha for writing such a beautiful story.
Best of luck.