বিশ্ববিদ্যালয়ে কিভাবে একজন গ্রামীণ শিক্ষার্থী পারে শহুরে সহ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মানিয়ে চলতে ?
স্কুল কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে মানুষ পদার্পণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে । বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির অর্থ ব্যাপক। এখানে সবাই শুধুমাত্র লেখাপড়া করতেই আসেনা, আসে জ্ঞান আহরন করতে, জ্ঞানের চর্চা করতে এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে। বলা হয়ে থাকে একজন শিক্ষার্থী তার জীবনের অন্যতম সেরা মুহূর্ত গুলো কাটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেননা এখানে স্কুল কলেজের মত বাধাধরা সময়ে ক্লাস হয়না ফলে দিনের বেশির ভাগ সময়টাই শিক্ষার্থীদের কাটাতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। যার দরুন সবচেয়ে বেশি সখ্যতা গড়ে ওঠে সহ শিক্ষার্থী দের সঙ্গে। কেননা সুখে, দুঃখে জীবনের অনেকটা দীর্ঘ সময় ৪ থেকে ৫ বছর তারা একত্রে কাটায়। নিজেদের অজান্তেই তারা হয়ে ওঠে পরিবার।
বর্তমানে দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ৪৬ টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০৩টি। সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বিভিন্ন শহর থেকে আসা শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি গ্রাম বা মফস্বল এলাকা থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যাটাও নেহাতি কম নয়। যদিও শহুরে শিক্ষার্থীদের সংখ্যাটাই বেশি। কেননা গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে খুব একটা সচেতন না। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে গ্রাম থেকে আগত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা।
গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে পারাটা অনেকটা স্বপ্ন পুরনের মতই ব্যাপার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতে অংশ নিতে হয় ভর্তি যুদ্ধে। আর এই ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে পারাটাও নেহাতি সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কেননা তারা শহরের শিক্ষার্থীদের মত সুযোগ সুবিধা পায়না, বেশির ভাগ সময়ই তারা ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং ও করতে পারেনা। এছাড়াও গ্রাম থেকে আগত বেশির ভাগ শিক্ষার্থীদের যেমন রয়েছে আর্থিক সমস্যা, তেমন রয়েছে আবাসন সংকট।
উচ্চশিক্ষা অর্জনের স্বপ্নে দীক্ষিত এসব শিক্ষার্থীরা যখন পরিবারের সান্নিধ্য থেকে দূরে, তখন তারা সবচেয়ে বেশি আপন করে নিতে চায় তাদের সহ শিক্ষার্থীদেরই। কিন্তু ইট,কাঠ,পাথরের দালানে বসবাসরত মানুষের মন জয় করে তাদের আপন হয়ে উঠাটা মোটেও সহজসাধ্য নয়, তাছাড়া শহুরে এবং গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও রয়েছে বিস্তর ফারাক, এছাড়াও গ্রাম থেকে আশা শিক্ষার্থীরা শহুরে শিক্ষার্থীদের মত বিলাসী ভাবে বেড়ে উঠে না। তাই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতার বিষয় হচ্ছে তাদের সহ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারা।
বেশির ভাগ সহ শিক্ষার্থীই থাকে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান, যাদের চালচলন, জীবনযাপন, কথাবার্তা কোন কিছুই খাপ খায় না গ্রাম থেকে আসা সাদাসিধে এসব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। গ্রামীণ পরিবেশে বড় হওয়া এসব শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠে প্রকৃতির মুক্ত পরিবেশে। শহরের শিক্ষার্থীদের মত তারা চালচলনে স্মার্ট বা তাদের পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল না হলেও সাদাসিধে এসব মানুষ খুব তাড়াতাড়ি অন্যকে আপন করে নিতে পারে, কেননা তাদের মধ্যে থাকেনা কোন অহঙ্কার, থাকেনা কোন ধর্মীয় বিভেদ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা তাদের সহ শিক্ষার্থীদের আপন করে নিতে সক্ষম হয় তাদের নিরহঙ্কার, সততা, ভালবাসা এবং আন্তরিকতা দিয়ে।
প্রতিবন্ধকতা থাকলেও গ্রামীণ পরিবেশে বড় হওয়া এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃতিগত ভাবেই থাকে বিশেষ কিছু গুন, যার ফলে তারা খুব সহজেই অন্যকে আপন করে নিতে পারেঃ
সততা:
মানব চরিত্রের অন্যমত এই মহৎ গুনটি বেশিরভাগ গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। অন্যায় ও অবৈধ কাজ না করে ন্যায় ও সত্যের পথে তারা জীবন পরিচালনা করে। আর সৎ লোক মাত্রই চরিত্রবান ও মহৎ হয়ে থাকে। যার ফলে তারা সহজেই বিশ্বাস ভাজন হয়ে উঠতে পারে। প্রথম দিকে হয়ত শহরের স্মার্ট, পরিপাটি বন্ধুদের সাথে খাপ খাওয়াতে সমস্যা হয়। কিন্তু নিজেদের গুনের দ্বারা তারা সহ শিক্ষার্থীদের মনে জায়গা করে নিতে পারে।
বন্ধুবৎসল মনভাব:
গ্রামের মানুষেরা স্বভাবতই বন্ধুবৎসল হয়ে থাকে। কেননা তারা শহুরে মানুষের মত আত্মকেন্দ্রিক নয়। বন্ধুর বিপদে তাদের পাওয়া যায় সবার আগে। নিজেদের এই গুনের দ্বারা সহজেই তারা সহ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারে।
সরলতা:
প্রকৃতির কোলে বড় হওয়া এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছে সরলতা। সাদাসিধে থাকতে অভ্যস্ত এসব মানুষের মধ্যে থাকেনা কোন শঠতা, থাকেনা কোন ঘোরপ্যাঁচ। আর এর মাধ্যমেই তারা সহ শিক্ষার্থীদের মনে জায়গা করে নিতে পারে।
মনুষত্ব:
অন্যান্য প্রাণি এবং মানুষের মধ্যে পার্থক্য হল মনুষত্বের। যা অন্য কোন প্রাণির নেই। ধনি-গরিব, সাদা-কাল, হিন্দু-মুসলিম বিভেদ না করে মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে পারাটাই হল প্রকৃত সার্থকতা। গ্রাম থেকে আসা সাদাসিধে এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে থাকেনা কোন ধর্মীয় বিভেদ বা অন্যকে ছোট করে দেখার প্রবনতা। শহুরে সহ শিক্ষার্থীরা তাদের এই সদ্গুনে গুনমুগ্ধ হয়।
চালচলন, জীবন ব্যবস্থা হয়ত ভিন্ন,সহ শিক্ষার্থীদের মত অবস্থাভাবাপন্ন না হলেও নিজ গুনের দ্বারাই গ্রাম থেকে আসা শিক্ষার্থীরা তাদের সহ শিক্ষার্থীদের মনে জায়গা করে নিতে পারে। আর মুক্তমনা সহ শিক্ষার্থীরা যখন চালচলন, বেশভূষা কে গুরুত্ব না দিয়ে প্রকৃত মনুষত্বের পরিচয় দিয়ে তাদের গ্রাম থেকে আসা বন্ধুটিকে আপন করে নেয়, তখন তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পায় ভিন্ন ধরন, সংমিশ্রণ ঘটে নানা ধর্মের, নানা মতের মানুষের।
সবসময় যে তারা সহ শিক্ষার্থীদের সাথে মানিয়ে চলতে পারে তা নয়, এর বিপরিত চিত্রও দেখা যায়। পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকা এসব শিক্ষার্থীরা যখন তাদের সহ শিক্ষার্থীদেরই তাদের পরিবার হিসেবে মেনে নিতে চায়, তাদেরকে আপন করে নিতে চায়। তখন অনেক ক্ষেত্রেই সহ শিক্ষার্থীরা গ্রাম থেকে আসা সাদাসিধে মানুষটিকে বন্ধু হিসেবে আপন করে নিতে পারেনা। অনেক ক্ষেত্রেই তারা হেয় প্রতিপন্ন হয় এবং সম্মুখীন হয় র্যাগিংয়ের, এর দরুন তাদের মুখোমুখি হতে হয় নানা রকম লজ্জাজনক পরিস্থিতির। ফলে তারা সম্মুখীন হয় নিদারুন মানুষিক কষ্টের। দিনের পর দিন তাদের সহ্য করতে হয় সহ শিক্ষার্থীদের দুর্ব্যবহার, নিদারুন মানুষিক যন্ত্রণা এবং যার ফল স্বরূপ তারা বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ।

আর এটি দেশের অন্যমত সেরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত বছর গুলোতে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দেখানো হয়েছে। দেশের অন্যমত সেরা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবনতা দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এর অন্যতম কারন হিসেবে দেখা যায় অনেক শিক্ষার্থীই তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সহ শিক্ষার্থীদের দুর্ব্যবহার এর জন্য বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। সামান্য ভুলে ঝরে পরে তাজা প্রান।
অন্যদিকে আবার দেখা যায়, শহরের উচ্চবিত্ত শিক্ষার্থীদের সাথে মিশতে গিয়ে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা তাদের অন্ধ অনুকরন করে ফলে তারা তাদের নিজেদের শিকড় কে ভুলে যেতে চায়। চার দেয়ালে বসবাসরত মানুষের সাথে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নিজেকে ভুলে যায়। অনেক সময় চালিত হয় ভুল পথে, যার দরুন পরিবারের সাথে তৈরি হয় দূরত্ব। অনেকেই জড়িয়ে পরে নানা রকম অপরাধমুলক কাজে। অনেকেই হয় নেশা গ্রস্থ। অপসংস্কৃতির চর্চা করতে গিয়ে তারা নিজের সংস্কৃতিকে ভুলে যায়।

শহরের শিক্ষার্থীদের সাথে মিশতে গিয়ে গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা অনেক সময় জড়িয়ে পরে রাজনীতিতে। সুস্থ ধারার রাজনীতি দেশের জন্য সবসময়ই মঙ্গলজনক। কিন্তু অনেক সময়ই তারা চর্চা করে ভিন্ন ধারার রাজনীতি যা কিনা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
ভাল- খারাপ মিলেই মানুষের জীবন। আর ছোট পরিসরের জীবনে ইতিবাচক মনোভাব বজায় রেখে সহ শিক্ষার্থীরা যদি গ্রাম থেকে আগত শিক্ষার্থীদের ধনি-গরিব বিবেচনা করে বন্ধু হিসেবে আপন করে নিতে পারে তবেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হয়ে উঠে অনন্য। আর এর মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার প্রকৃত সার্থকতা প্রকাশ পায়। কেননা স্বার্থপরতা নয় মিলেমিশে একত্রিত হয়ে জ্ঞান আহরন করতে, জ্ঞান এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে এবং সর্বোপরি সুস্থ সংস্কৃতি অনুশীলন করতে পারাটাই হল প্রকৃত সার্থকতা। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বন্ধুত্বের স্থায়িত্ব হয় দীর্ঘ সময়ের জন্য। কেননা জীবনের ৪ থকে ৫ টি বছর তারা একসাথে কাটায়। বন্ধুত্ব পরিণত হয় পরিবারে। অনেক সময় দেখা যায় সঙ্গে থাকা হিন্দু বন্ধুটিও মুসলমান বন্ধুর সাথে ঈদের উৎসবে শামিল হচ্ছে। আবার এরকম বন্ধুত্বের সংখ্যাও কম নয় যেখানে হোস্টেলে থাকা গ্রামের বন্ধুটির সাথে শহুরে বন্ধুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে চাকরিতে প্রবেশের পরেও এ বন্ধুত্ব থাকে অমলিন। প্রানের বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক হয় আজীবনের।