প্রথমেই জেনে নেই সহিংসতা কি?
সহিংসতার একটা ব্যাপার হলো যখন কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে সহিংস আচরণ করেন, তখন অপর ব্যক্তিটিকে তিনি আর মানুষ জ্ঞান করেন না বরং একটা অবজেক্ট হিসাবে জ্ঞান করেন। এছাড়াও তিনি তার স্বাধীনভাবে নির্বাচন করার ক্ষমতাকে রহিত করেন। সহিংসতা কি তা আসলে বুঝা সহজ নয়। কারণ হয়তো এখনো মানুষ সহিংসতা কি তা জানেনা।
ঘরোয়া সহিংসতা বেশিরভাগ ঘটে নারীদের সাথে। দেখা যায়, বেশিরভাগ মহিলাই বিয়ের পর কোনো না কোনোভাবে ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। দীর্ঘদিনের কুসংস্কার ও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাবের ফলে সৃষ্ট সহিংসতার মতো জটিল সমস্যা শুধু আইন দিয়ে সমাধান করা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে দরকার সচেতনতা।

ঘরোয়া সহিংসতার শিকার শুধু নারীরাই নয়, শিশুরাও। ঘরে ঘরে বিভিন্ন ধরনের সহিংস আচরণের শিকার হচ্ছে শিশুরা। শিশুর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে দারিদ্র্য একটা বড় ভূমিকা রাখে। কিশোরী মেয়েরা অনেক সময়ই ঘরে সহিংসতার পাশাপাশি যৌন হয়রানির শিকার হয়। তারা এক গৃহ দাসত্বের কবলে পড়ে। বলাই বাহুল্য, এরা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত।
এদিকে ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে। অনেক বিবাহিত কিশোরী শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হয়। এই বয়সী মেয়েদের ৩৩ শতাংশ মনে করে, স্বামীর তাদেরকে মারধরের অধিকার আছে। যুগ যুগ ধরে এ ঘরোয়া সহিংসতা চলে আসছে। যারা এ সহিংসতার শিকার হচ্ছে তারা মেনেও নিচ্ছে।

নারী পুরুষের একটা বড় অংশ সহিংসতা বলতে মারধরকেই বোঝেন। প্রায় কেউই স্বামীর হাতে ধর্ষনের ঘটনাকে নির্যাতন মনে করেন না। স্বামীর বকাঝকাও স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে নেন। তবে উত্ত্যক্তকরনকে তারা যৌন হয়রানি বলেছেন। বেসরকারি সংস্থা ব্রাকের একটি জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। সহিংসতা সম্পর্কে জানতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশের ৪ হাজার ৮০০ নারী পুরুষের মধ্যে এই জরিপ চালানো হয়। সেখানে উত্তরদাতা নারী পুরুষের হার ছিলো সমান। জরিপের তথ্য আরো বলছে, গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার খবর উপস্থাপন নিয়ে ৯১ শতাংশ মানুষ অসন্তুষ্ট। জরিপে অংশ নেওয়া নারী পুরুষের ৪০ শতাংশ নারীর প্রতি সহিংসতা বলতে শুধু মারধরকেই বোঝেন। তবে ৭ শতাংশ মারধরের ভয় দেখানোকেও সহিংসতা বলেছেন।

গণমাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতার খবর উপস্থাপন নিয়ে প্রতি ১০ জনে ৯ জন অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা এ ধরনের খবরে রগরগে বর্ননা দেয়ার প্রবনতা বন্ধ এবং আক্রান্তের নাম পরিচয় প্রকাশ না করতে বলেছেন।
জরিপের শেষাংশে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ার কারণ হিসেবে মোটা দাগে মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে চিহ্নিত করেছেন। নারী পুরুষেরা এর পাশাপাশি পপুলার কালচার অর্থাৎ নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন কিংবা ইউটিউবে নারীকে আপত্তিকরভাবে উপস্থাপনের কারনেও নারীর প্রতি সহিংসতা এবং রূঢ় আচরণ বাড়ছে বলছেন ৬৫ শতাংশ নারী পুরুষ।
বিস্ময়কর হলেও সত্যি, ঘরোয়া সহিংসতার স্বীকার শুধু নারী বা শিশুরা নয়, অনেকক্ষেত্রে পুরুষরাও এর স্বীকার। নারী এবং শিশুদের ক্ষেত্রে আইনের সাহায্য নেয়া সম্ভব হলেও অনেক পুরুষই নীরবে সয়ে যান। হয়তোবা অনেকে বুঝতেই পারেন না তাদের কোথায় যাওয়া উচিত, কি করা উচিত। স্ত্রীদের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের স্বীকারও হন অনেক পুরুষ। সমাজে, পরিবারে, বন্ধুমহলে এমনকি আইনী সহায়তা চাওয়ার ক্ষেত্রেও অনেক সময় প্রতিবন্ধকতা থাকে। লজ্জায়, অপমানে মুখ খোলেন না তারা।

মোট কথা, ঘরোয়া সহিংসতা যে কারো ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে, হতে পারে পুরুষ, নারী বা শিশু। সচেতনতা ও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এর প্রতিকার সম্ভব। তবে তার আগে জানতে হবে, কেন হচ্ছে এ সহিংসতা। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে বলেই সহিংসতা বেড়ে চলেছে দিনের পর দিন। একটি শিশু যে তার পরিবারে সহিংস আচরণ দেখে বড় হচ্ছে, সে সেটাই শিখবে এবং পরবর্তীতে সে এরূপ আচরণই করবে। এটাই স্বাভাবিক। একজন মানুষ তার পরিবার থেকেই প্রথম শিক্ষা পায়, এবং সেভাবেই গড়ে উঠে৷ সমাজ থেকে সহিংসতা দূর করতে হলে প্রথমে পরিবারের সহিংসতা রোধ করতে হবে।