মানুষের ৫টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা একটি। মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সত্ত্বেও তা দেখা মেলেনা আমাদের দেশে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান কিংবা শিক্ষার চাহিদা মিটলেও এদেশে চিকিৎসার উপর নির্ভর করতে পারেন না অনেকেই। দেশের চিকিৎসকেরা তাই প্রায়ই অবমূল্যায়িত হচ্ছেন। তবে এর উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ রয়েছে যা নিচে বর্ণিতঃ-
১) ভুল চিকিৎসাঃ
প্রাণ সব কিছু থেকে অধিক মুল্যবান। তাই সবাই চায় দীর্ঘায়ু এবং সুস্বাস্থ্য। কিন্তু কেউকি চায় ভুল চিকিৎসায় প্রিয়জনকে হারাতে? বাংলাদেশ সোসাইটি ফর এনফোর্সমেন্ট অফ হিউম্যান রাইটস এর সমীক্ষা অনুযায়, ২০১১-২০১৭ সালের মধ্যে ভুল চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৫৫০জন। যার মধ্যে শুধু ২০১২ সালে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয় প্রায় ১৪১জনের। ভুল চিকিৎসা/ অপচিকিৎসার মূল কিছু কারণ নিচে উল্লেখ করা হলোঃ-
জাল ডাক্তার ও জাল সার্টিফিকেটঃ আমাদের দেশে যে কেউই ইচ্ছা হলে হয়ে যান ডাক্তার। জাল সার্টিফিকেট জোগাড় করে নিমিষে শুরু করেন তথা কথিত চিকিৎসা অর্থাৎ অপচিকিৎসা। সরল লোকেরা না জেনেই তাদের কাছে যান রোগ থেকে মুক্তি পেতে, কিন্তু তা আর হয়না বরং এই দেবতুল্য ডাক্তারের জন্য অকালেই প্রাণ হারাতে হয়। তৎপরতার অভাবেই মুলত এরা অপচিকিতসার সুযোগ পায়।
ভেজাল, নকল ও মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ ঔষধঃ অধিক লাভের আশায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিয়ে আসেন ভেজাল ও নকল ঔষধ। মানুষের সরল আস্থা ও বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে তারা লাভবান হওয়ার চেষ্টা চালায়। মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রয়েও দ্বিধা বোধ করে না। এই ভুল ও মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ ঔষধ সেবনের ফলে স্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটে, যার দায় আসে ডাক্তারদের উপর। তা আসাই স্বাভাবিক, কেননা প্রায়শই এদের সাথে ডাক্তারদের হাত থাকে। তবে তা প্রতিরোধ করতে হলে এই নকল ঔষধ উৎপাদন বন্ধ করা সবচেয়ে জরুরী। ফার্মাসিগুলোতে নিয়মিত তৎপরতার প্রয়োজন যাতে মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ ঔষধ ধরা পড়ে। সম্প্রতি ফার্মাসিগুলোতে পুলিশি তৎপরতায় ভেজাল ও মেয়াদ উর্ত্তীর্ণ ঔষধ ধরা পরেছে বলে জানা যায়। এই উদ্যোগটি খুবই প্রশংসনীয়।
অসাবধানতাঃ আমাদের দেশ স্বাধীন হলেও রয়েছে বৈষাম্য। তাই ধনীরা পান প্রাধান্য কিন্তু দরিদ্রেরা গুরুত্ব পান না। একরকম হেয় মনে করেই তারা দ্ররিদ্র শ্রেণীর লোকদের চিকিৎসা করে থাকে বলে জানা গেছে।

২) ব্যয়বহুল চিকিৎসাঃ
ভালো চিকিৎসার জন্য অধিক খরচের প্রয়োজন। বিশেষ করে কঠিন রোগ যেমনঃ ক্যন্সার, এইডস, হৃদযন্ত্রের রোগ ইত্যাদির চিকিৎসা অত্যাধিক ব্যয়বহুল যা উচ্চবিত্তদের জন্যেও কষ্টসাধ্য। তাই এতো অর্থের বিনিময়ে দেশি ডাক্তারদের উপর আস্থা রাখতে নারাজ বহু রোগী।

৩) দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার অভাবঃ
বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি আশানুরুপ। তাছাড়া হৃদরোগের চিকিৎসা , কিডনি ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে চিকিৎসার মাধ্যমে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে নিরাময় পায়নি প্রায় কেউই। বরং ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কবলে, বৃথা অর্থ হয়েছে নষ্ট।

উল্লিখিত কারণে তাই অনেকেই দেশি ডাক্তারদের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন। পুলিশদের প্রতি যেমন কিছুকাল আগেই এদেশের মানুষ আস্থা হারিয়েছেন, তেমনি ঘটেছে চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও। তাই স্বামর্থশালিরা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়াই অধিক নিরাপদ মনে করেন।
চিকিৎসার জন্য বিদেশঃ
যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, ভারত, কানাডা প্রভৃতি দেশে পারি জমান চিকিৎসার উদ্দেশ্যে। তা করবেনই বা না কেন। এসব দেশের ডাক্তারবৃন্দ নিরাময় করতে সক্ষম হয়েছে দূরারোগ্য ব্যাধিসমূহ। রেডিয়েশন চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পুর্ণভাবে ক্যান্সার রোগের নিরাময় করতেও সক্ষম হয়েছেন। যদিও বিদেশে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন মোটা অংকের টাকা, প্রাণের চেয়ে বেশি কিছুই হতে পারেনা। আবার বিদেশে কম অর্থেও চিকিৎসা সম্ভব যা মধ্যবিত্তদের জন্যও একটি সুখবর।

বাংলাদেশে চিকিৎসা সম্ভাবনাঃ
বাংলাদেশেও যে ভালো চিকিৎসক নেই, তা বললে ভুল হবে। সব ডাক্তার অসাধু নয় এবং আমাদের দেশেও শুরু হচ্ছে উন্নত চিকিৎসা। গত কয়েক দশকে দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে চিকিৎসা ক্ষেত্রে। ১৯৯০ সালের দিকে যক্ষা রোগকে জনগণ বেশ ভয় পেতেন কেননা যক্ষায় মৃত্যুর ঘটনা শোনা যেত। কিন্তু ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায় যক্ষায় মৃত্যুর হার ১% এরও নিচে(০.০০৩৪%)।
হৃদরোগ চিকিৎসায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে এদিকেও বেশ উন্নতি লক্ষণীয়। রিং পড়ানো, ওপেন হার্ট সার্জারি, পেস মেকার পড়ানো ইত্যাদি বিষয়ে দেশি ডাক্তারেরা দিন দিন অধিক সফলতা অর্জন করছেন।
ক্যান্সার রোগ নিরাময় এখনো এদেশে সম্ভব হয়নি কিন্তু গড়ে উঠেছে ক্যান্সার ট্রিট্মেন্টের জন্য কিছু হাসপাতাল। যেখানে কয়েকটিতে রেডিয়েশন থেরাপিরও ব্যবস্থা রয়েছে।

বাংলাদেশি ডাক্তারেরা দ্রুতই আধুনিক দেশগুলোর মতো চিকিৎসা করতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। এমন কি বর্তমানেও অনেক কঠিন রোগের নিরাময় করতে সক্ষম হয়েছেন দেশী ডাক্তারেরা। বিদেশের মতো অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি আমাদের দেশের সর্বত্র না থাকলেও বেশ কিছু সনামধন্য হাসপাতালে বিদেশের মতোই চিকিৎসা ব্যবস্থার দেখা মেলে। এর মধ্যে স্কয়ার হাসপাতাল ও এপোলো হাসপাতাল উল্লেখ্যযোগ্য। দেশে এতো ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও অনেক মানুষ বেছে নেন বিদেশী চিকিৎসা। দেশের কিছু অসাধু ডাক্তারদের জন্য সুনাম ও জনগণের আস্থা পাননা সৎ ও বিজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দ। আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে ভ্রান্ত ডাক্তার ও অসাধু ব্যবসায়ীদের উপড়ে ফেলতে পারলেই সঠিক মুল্যায়ন হবে দেশী চিকিৎসকদের। তাহলেই জনগণের হৃদয়ে আস্থাবান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবেন তারা।