রোজা (ছদ্মনাম) তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তাদের ক্লাসের “ফার্স্ট গার্ল” তান্নি (ছদ্মনাম)। একদিন রোজা তান্নিকে জিজ্ঞেস করে বসল, “তান্নি তোমার কি খুব বড় কোন অসুখ হয়েছে?” তান্নি অবাক হয়ে বলল, “কই নাতো?”, রোজা প্রতিউত্তরে যা বলল তা হল, “ তাহলে তুমি এত কালো কেন?” তান্নির গায়ের রং ক্লাসের সব শিক্ষার্থীদের চাইতে আলাদা ছিল, তামাটে যাকে আমরা প্রচলিত ভাষায় “কালো” বলি, ইংরেজিতে বলি “ ডার্ক”।
অপরদিকে, রাইয়ানের একটি ছোট বোন হয়েছে, ফুটফুটে বোনটি রাইয়ানের মত ফর্সা হয়নি। রাইয়ান খুব গর্ব করে বোনকে দেখতে আসা অতিথিদের বলছে “ও একটা কালো হইসে, আমার থেকেও কালো, বিয়ে দিবা কেমনে?।” রাইয়ানের মা অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন ভেবেই পেলেন না একটা ৭ বছরের বাচ্চা ছেলে কেমন করে তার সদ্য জন্ম নেয়া বোনের বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে! পরে দেখা গেল যে রাইয়ান এই কথাগুলো তার ফুপু ও দাদিকে আলাপ করতে শুনেছে। মজার বিষয় হল, রাইয়ান যখন একজন পরিপূর্ণ যুবক হবে, তখন সে প্রেমে পড়ার সময়েও ফর্সা মেয়েকে দেখেই নিজের অজান্তে প্রেমে পরবে। ঠিক এই ভাবে তুমুল বিতর্কিত “বর্ণবাদ” প্রথাকে সাধুবাদ জানিয়ে এবং আমাদের সামাজিক মূল্যবোধকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে “সাদা চামড়া ও কালো চামড়ার “ বিতর্ক চলতেই থাকবে।

সৌন্দর্য সেকি কেবলি রংয়ে, গুনে নয়? যখনি আমরা সৌন্দর্যের কথা ভাবি, আমাদের মনের অগোচরে সৌন্দর্যের মাপকাঠি আমরা গায়ের রং দিয়ে করে ফেলি। কবিদের গল্পে, কবিতায় যতই “কাজল কালো শ্যামল বরণ” বা “কালো সে তো মনের ভাল” নায়িকার প্রেমে পরি না কেন, বিয়ের বাজারে নেমে প্রথমেই যেই আর্জি পেশ করি তা হল “পাত্রি/পাত্র কিন্তু ফর্সা হওয়া চাই”। কখনও কি এমন কথা শুনেছেন যে গুণধর ফর্সা ছেলেটির জন্য বিয়ের পাত্রী খুঁজতে গিয়ে “মেয়ে কালো হলে ক্ষতি নেই, গুনী হলেই চলে” এমনটি বলতে? বরং একজন কালো পাত্রের পরিবার হন্যে হয়ে ফর্সা পাত্রী খুজেন, নয়ত সন্তান গুলোও যে কালো হবে! হ্যাঁ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাতিক্রম দেখা যায়, কিন্তু আমাদের দেশের সামগ্রিক সামাজিক মনোভাব গায়ের রং এর ব্যাপারে খুবই আপোষহীন!
আমাদের এশিয়ান উপমহাদেশে, যেমনঃ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের গায়ের রং তামাটে বা শ্যাম বর্ণের হয়ে থাকে। যার ফলে দেখা যায় অপেক্ষাকৃত গৌর বা ফর্সা গায়ের রংকে সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে সবচাইতে উপরে রাখা হয়। সোজা কথা, ফর্সা চামড়ার কদর আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি। একটি শিশু যখন জন্ম নেয়, প্রথমেই শিশুটি সুস্থ আছে কিনা তা জানতে চাওয়ার আগেই একটি বহুল জনপ্রিয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় শিশুটির মা – বাবা ও পরিবারের সদস্যদের, আর তা হল “বাচ্চার গায়ের রং কেমন? কালো হয়নি তো?”। মজার কথা হল, এই ধরনের প্রশ্নকে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেও অবান্তর মনে করা হয় না, বরং বেশ বাস্তবসম্মত ভাবাবেগ হিসেবেই দেখা হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে (!) যদিও বা শিশুটি কালো গায়ের রং নিয়ে জন্মায়, তার উপর শিশুটি যদি মেয়ে শিশু হয়, তাহলে তো কথাই নেই। শিশুর মা – বাবার জন্য শিশুর সুস্থতা যথেষ্ট হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় পরিবারের সদস্যদের দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না! শিশুর মা স্বয়ং যতই উচ্চ শিক্ষিত হন না কেন, বা ভাল চাকুরিজীবী, প্রসুতি ঘর থেকেই তার কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ পরে যায় যে ”এই কালো মেয়েকে বিয়ে দিতে কষ্ট হবে নাতো”! কারন, মা ভাল করেই জানেন “বিয়ের বাজারে” ফর্সা চামড়ার কত কদর!

আমাদের সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে একজন নারী বা ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষও, যতই মেধাবী হন না কেন, হোক সে ডাক্তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বা বিসিএস কর্মকর্তা, গায়ের রং কালো হলেই তাদের জীবনের অর্ধেকটারও বেশি সময় পার হয় কালো গায়ের রং নিয়ে হীনমন্নতায় ভুগে। যদিও বা পারিবারিকভাবে কালো ছেলে বা মেয়েটি কোন অবজ্ঞার স্বীকার নাও হয়, কিন্তু শিক্ষা জীবনে, এমনকি চাকুরিক্ষেত্রে, প্রেমের সম্পর্কে এবং বিয়ের ক্ষেত্রেও, কোন না কোন ভাবে তারা হেনস্তার স্বীকার হন, শুধুমাত্র গায়ের রং এর কারনে। সবচাইতে মজার বিষয় হল, এখনও আমাদের দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে কালো মেয়েদের বিয়েতে যৌতুকের টাকার পরিমান অপেক্ষাকৃত “বেশি” ধার্য করা হয়। কিন্তু কেন? স্বাভাবিকভাবেই কালো মেয়েটিকে বিয়ের জন্য বেশির ভাগ সময় প্রস্তাব আসেই না বলতে গেলে, ফলে মেয়ের পরিবার প্রয়োজনে বেশি টাকা যৌতুক দিয়ে হলেও মেয়েটার একটা গতি (!) করতে চায়। পক্ষান্তরে, মেয়ে যদি ফর্সা হয়, তবে মেয়ে অশিক্ষিত হলেও ক্ষতি নেই, অনেক ক্ষেত্রে যৌতুকের টাকার পরিমান কমই নেয়া হয়।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের গ্রামাঞ্চলে এই অবস্থা আরও করুণ। কিন্তু যেহেতু ভারতে শিক্ষার হার ভাল এবং মেয়েরা দিন দিন স্বাবলম্বী হওয়ার দিকে তুলনামূলকভাবে আগের চাইতে বেশি জোর দিচ্ছে, ফলে শুধুমাত্র গায়ের রং এর পক্ষপাত দুষ্ট মানসিকতার বিরূপ প্রভাব কিছুটা হলেও কমে আসছে সেখানে।
ফর্সা গায়ের রং এর উপর দুর্বলতার প্রচণ্ড রকম পক্ষপাতিত্ব সবচাইতে বেশি নজরে পড়ে টিভি বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে তাকালে। পাশ্চাত্যের ফর্সা চামড়ার প্রতি চরম আকর্ষনের ফলাফল স্বরূপ সফল প্রসাধনী ব্র্যান্ড ভারতের বহুল জনপ্রিয় “ফেয়ার এন্ড লাভ্লি”, যার একমাত্র কাজ হল “কালো চামড়া সাদা করা”। একটা সময় এই বিজ্ঞাপনের অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল, কালো মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, ফেয়ার এন্ড লাভ্লি মেখে ফর্সা হয়ে যাওয়াতে মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করে হয়ে গেল। এত বড় ডাহা মিথ্যা বলেও আশ্চর্যের ব্যাপার হল যুগের পর যুগ এই প্রসাধনীটি আজও ভারতে অন্যতম জনপ্রিয় ও বাংলাদেশের বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশ্বখ্যাত লাক্স সাবানেরও এখন পর্যন্ত শ্লোগান হচ্ছে “সৌন্দর্য আমার অধিকার”, বলা বাহুল্য এখানে সৌন্দর্য মানেই ফর্সা গায়ের রং। মিস ওয়ার্ল্ড ঐশ্বরিয়া, দিপীকা পাডুকনের মত অভিনেত্রীদের দেখা যায় এই ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে। অথচ মিস ওয়ার্ল্ড প্রিয়াঙ্কা চোপরা সম্প্রতি জোরালোভাবে পর্দায় কোন রকম ফর্সা দেখাবে এমন মেকআপ ছাড়াই তার সত্যিকারের কালচে ত্বক নিয়েই পর্দায় হাজির হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং অতি সম্প্রতি তার প্রজেক্টগুলোতে তা করেও দেখিয়েছেন।
অতিসম্প্রতি, কোরিয়ার প্রসাধনী ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্ডাস্ট্রি বিশ্বে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে প্রথম সারিতে চলে এসেছে। এর বড় কারন কোরিয়ানদের শো – বিজ সেলিব্রিটিদের ঝা ঝকঝকে “গ্লাস স্কিন” ও “তুষার শুভ্র” ত্বক। সাদা চামড়ার প্রতি প্রচণ্ডভাবে আশক্ত কোরিয়ান নাগরিকদের প্রবল চাহিদার ফলে মুলত কোরিয়ান প্রসাধনী ইন্ডাস্ট্রি পুরোপুরি ভাবে “তুষার সাদা ও দাগহীন ত্বক”কে উপজীব্য করে নতুন নতুন প্রসাধনী নিয়ে আসছে। যার একটা বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে ইতোমধ্যে পড়া শুরু করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ, যাদের বেশির ভাগই মেয়ে, কোরিয়ানদের মত ফর্সা দাগহীন ত্বক পাওয়ার আশায় কোরিয়ান প্রশাধনীর উপর ঝুকে পরেছে। হাজার হাজার টাকা খরচ করে এইসব প্রসাধনী যে ভাল ফলাফল দিচ্ছে তাও কিন্তু নয়, এক জরিপে দেখা গেছে এইসব প্রসাধনীর অনেক গুলোই বাংলাদেশের আবহাওয়ার উপযোগী নয়।
বিশ্বব্যাপী “বর্ণভেদের” বিরূপ প্রভাব সব দেশেই দেখা যায়, এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে এই সমস্যা আরও প্রকট। বিশেষ করে শো-বিজ ইন্ডাস্ট্রিতে গায়ের চামড়ার রং এর উপর ভিত্তি করে পারিশ্রমিক ধার্য করা হয়। তবে পশ্চিমা বিশ্বে এই অবস্থা এতটাও খারাপ নয় যতটা আমাদের এশিয়ান উপমহাদেশে এখনও রয়েছে। গায়ের রং এর রকমফের যে কিছু হরমোনের তারতম্যে হয় তা আমরা জেনেও জানতে চাই না। দিন শেষে আমরা সবাই সুন্দর দেখতে চাই, নিজেকে সুন্দর দেখাতে চাই। কবে ছোট রাইয়ান দের শেখানো হবে যে তার বোনটিও ঠিক রাইয়ানের মতই, সুন্দর ও আদুরে, তার “শ্যাম” বর্ণের কারনে ঠিক যেমন তার মা বাবার আদুরে কমতি হবে না, ঠিক তেমনি রং কোনভাবেই একজন মানুষের যোগ্যতার মাপকাঠি হয় না। একজন তুখোড় মেধাবী যখন তার মেধা দিয়ে জোরালো অবস্থান তৈরি করে তখন তার সাদা বা কালো গায়ের রং এর কোন অবদানই থাকে না। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটা খুব দরকার আমাদের, মানসিকতার আজকের পরিবর্তন ভবিষ্যতে অনেক অন্যায় বৈষম্যের বিলুপ্তি ঘটাবে। কালো ত্বকের মুখে বসানো মায়াবি চোখ, বা তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত হাসি দেখার মন তৈরি করার সময় এসেছ এখন।